মহা মানব কে জানুন

নবী মুহাম্মদ (সাঃ) কে?

এক ¯্রষ্টার উপাসনা ও আনুগত্যের লক্ষ্যে নবী রাসুলদের আগমনের দীর্ঘ ধারায় সর্বশেষ নবী হলেন হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)। পৃথিবীতে যত নবী-রাসুল এসেছেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন- আদম, নুহ, ইব্রাহিম, ইসমাইল, ইসহাক, জাকারিয়া, ইউসুফ, মুসা, দাউদ, সুলাইমান এবং ঈসা প্রমুখ। এদের সকলের উপর শান্তির ধারা বর্ষিত হোক।
“প্রকৃতপক্ষে তোমাদের জন্যে খোদার রাসূলের জীবনে এক সর্বোত্তম নমুনা বর্তমান রয়েছে এমন প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য, যে আল্লাহ ও পরকালের প্রতি বিশ্বাসী এবং খুব বেশী করে খোদার স্মরণ করে।’ (কুরআন – ৩৩:২৯)
যেমন মুসা (আঃ) কে তওরাত এবং ঈসা (আঃ) কে ইঞ্জিল নামক ঐশী গ্রন্থ দিয়ে পাঠানো হয়েছিল (বর্তমানের সংযোজিত পরিমার্জিত তওরাত ও ইঞ্জিল নয়)। তেমনই মুহাম্মদ (সাঃ) কে আল-কুরআন দিয়ে পাঠানো হয়েছিল যাতে করে কুরআনের নিয়ম-বিধান বাস্তবায়িত করা যায়। নবী (সাঃ) এর স্ত্রী আয়েশা (রাঃ) কে নবী (সাঃ) এর জীবন সম্পর্কে বর্ণনা করতে বলা হয় এবং তিনি উত্তরে বলেন, যে তিনি ছিলেন জীবন্ত কুরআন অর্থাৎ আল-কুরআনের মহান আদেশ ও নিষেধসমূহ তিনি তার দৈনন্দিন জীবনে পরিপূর্ণভাবে অনুসরণ করেছেন। তিনি কিভাবে কুরআনের মহান নির্দেশাবলীকে কাজে পরিণত করেছিলেন আমরা তা এবার আলোচনা করব।
করুণার প্রতীক
জনগণকে নামায, রোযা, দান-খয়রাত এর প্রতি আহŸানের পাশাপাশি মোহাম্মদ (সাঃ) জনগকে শিখাতেন যে ¯্রষ্টার প্রতি বিশ্বাস অন্যের সাথে আচরণকেও প্রভাবিত করে। তিনি বলেন ‘তোমাদের মধ্যে তিনিই উত্তম যার চরিত্র সর্বোত্তম’।
‘হে নবী আমি আপনাকে দুনিয়াবাসীদের জন্য করুণার আধার স্বরূপ পাঠিয়েছি।’ (কুরআন – ২১:১০৭)
নবী করীম (সাঃ) এর অনেক বাণী বিশ্বাস ও কাজের উপর গুরুত্বারোপ করে। উদাহরণ স্বরূপ- ‘যারা আল্লাহ এবং শেষ বিচারের দিনের প্রতি বিশ্বাস রাখে, তাদের উচিত অতিথীদের সম্মান ও উদারতার সাথে সেবা করা এবং যা ভালো ও কল্যাণকর তা বলা।’
শেষ বার্তাবাহক (তাঁর উপর শান্তির ধারা বর্ষিত হোক) মনুষ্যজাতিকে একে অপরকে করুণা এবং শ্রদ্ধা করতে শিখিয়েছেন। তিনি বলেছেন, যে অন্যের প্রতি দয়া প্রদর্শন করেন না, তার প্রতিও দয়া প্রদর্শন করা হবে না।”
অন্য এক বর্ণনায় আছে কিছু লোক অবিশ্বাসীদের শাস্তির জন্যে ¯্রষ্টার কাছে প্রার্থনা করতে বলেন, কিন্তু তিনি উত্তরে বলেন ‘আমাকে করুণা ছাড়া অভিসম্পাতকারী হিসাবে পাঠানো হয়নি।’
ক্ষমা-উদারতা
নবী করীম (সাঃ) ছিলেন সমস্ত জনগণের মধ্যে সবচাইতে বেশী ক্ষমাশীল এবং দয়ালু। কেউ যদি তাকে নিন্দামন্দ করত, তিনি তাকে ক্ষমা করে দিতেন এবং কঠোর, নির্মম-কর্কশ মানুষের সামনে আরো বেশী ধৈর্য্যশীল হতেন। তিনি ছিলেন চরম কোমল, সদয় এবং ক্ষমাশীল বিশেষত যখন তিনি ক্ষমতার অধিকারী হয়েও প্রতিশোধ গ্রহণ করতে পারতেন, কিন্তু তিনি তা করেন নি। তিনি ছিলেন ক্ষমাশীলতা ও ন¤্রতার মূর্ত্ত প্রতীক, কুরআনের এক আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে ‘হে নবী, ন¤্রতার নীতি অবলম্বন কর। ভালো কাজের উপদেশ দান করতে থাক এবং অজ্ঞ লোকদের এড়িয়ে চল।’ (কুরআন- ৭:১৯৯)
‘তাহাদের ক্ষমা করা উচিত, মার্জনা করা উচিত, তোমরা কি চাওনা যে আল্লাহ তোমাদেরকে মাফ করে দিবেন? আর আল্লাহর পরিচয় এই যে, তিনি বড়ই ক্ষমাশীল, করুণাময়’। (কুরআনÑ২৪:২২)
সাম্য-সমতা
নি¤œলিখিত বাণীতে নবী করীম (সাঃ) শিখিয়েছেন যে সমগ্র মনুষ্য জাতি ‘আল্লাহর দৃষ্টিতে সমান এবং সকল মানব আদম (আঃ) থেকে সৃষ্টি। অনারবের উপর আরবের, কালোর উপর সাদার কোন কর্তৃত্ব বা পদমর্য্যাদা নেই। “¯্রষ্টা তোমার চেহারা ও ধন-সম্পদ দেখে বিচার করবেন না, তিনি তোমাদের হৃদয় এবং কাজের প্রতি দৃষ্টিপাত করবেন।”
‘বস্তুতঃ আল্লাহর নিকট তোমাদের মধ্যে সর্বাধিক সম্মানীয় সে, যে তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে নীতিপরায়ণ।’ (কুরআন Ñ ৪৯:১৩)
একদিন নবী করিম (সাঃ) এর সাহাবী (সাথী) অন্য সাহাবী (রাঃ) কে উপেক্ষার ছলে ডাকেন ‘ও কালো মায়ের ছেলে’ নবী করীম (সাঃ) রাগান্বিত হলেন এবং বলেন ‘তার মা কালো তাই তাকে উপেক্ষা করছো? তুমি এখনও প্রাক-ইসলামী যুগের অজ্ঞতার মধ্যে থেকে গেছো’।
সহনশীলতা
নবী করীম (সাঃ) কারো উপর ব্যক্তিগত আক্রমণ, যুলুম বা নির্যাতনের প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘যে তোমার প্রতি খারাপ আচরণ করে তার প্রতি তোমার খারাপ আচরণ করা উচিত নয়, বরং উদারতার সাথে আচরণ করা উচিত।’
‘আর হে নবী! ভালো ও মন্দ সমান নহে। তুমি অন্যায় ও মন্দকে দূর কর, সেই ভালো দ্বারা যাহা অতীব উত্তম। তুমি দেখিতে পাইবে যে, তোমার সহিত যাহার শত্রæতা ছিল সে প্রাণের বন্ধু হইয়া গিয়াছে। (কুরআন – ৪১:৩৪)
অনেক ক্ষেত্রে নবী করীম (সাঃ) যারা তার উপর যুলুম-নির্যাতন করেছিল তাদের উপর প্রতিশোধ নিতে পারতেন, কিন্তু তিনি তা থেকে নিজেকে বিরত রেখেছিলেন।
বিপদ-আপদের সময় তিনি মানুষকে ধৈর্য্য ধারণ করার শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন ‘যে জনগণকে শক্তির দ্বারা পরাজিত করে সে শক্তিশালী নয়। সহনশীলতার অনুশীলনের অর্থ এই নয় যে মুসলিমরা শুধুই নীরব থাকবে এবং যে কোন আক্রমনের সময়ও নিজেকে রক্ষা করবে না, এমনটা নয় বরং নবী মোহাম্মদ (সাঃ) বর্ণনা করেন যে, ‘শত্রæর সাথে সাক্ষাতের ইচ্ছা কোরো না কিন্তু যখন সাক্ষাত হবে, মোকাবিলা করবে ও ধৈর্য্যশীল হবে। অর্থাৎ শত্রæর মোকাবিলায় দৃঢ়তার সাথে দাঁড়িয়ে থাকবে।
ন¤্রতা (ভদ্রতা)
একজন সাহাবী যিনি ১০ বছর মুহাম্মদ (সাঃ) এর সঙ্গদান করেছেন তিনি বলেন মুহাম্মদ (সাঃ) তাঁর সাথে আচরণের সময় সর্বদা অমায়িক এবং ভদ্র ছিলেন। ‘যখন আমি কোন কিছু করতাম তিনি কখনও আমার কাজের পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন করেননি। আমি যখন কোন কিছু করতে পারতাম না তখনও তিনি আমার ব্যর্থতা নিয়ে প্রশ্ন করতেন না। তিনি ছিলেন সকল মানুষের বন্ধুসুলভ।’
একবার নবী করীম (সাঃ) এর স্ত্রী এক ব্যক্তির দ্বারা অপমানিত হয়ে রাগান্বিত হলে তিনি বলেন ‘ও আয়েশা, ন¤্র ও শান্ত হও! কেননা আল্লাহ সকল কাজে ন¤্রতাকে পছন্দ করেন’।
তিনি আরও বলেন ‘ন¤্রতা দেখাও। কেননা কোন কিছুতে ন¤্রতা দেখা গেলে সেটা তাকে সৌন্দর্যমন্ডিত করে এবং যখন কোন কিছু থেকে ন¤্রতা বের করে নেওয়া হয় সেটা অশোভনীয় হয়ে পড়ে’।
‘হে নবী, ইহা আল্লাহর বড় অনুগ্রহের বিষয় যে, তুমি এই সব লোকেদের জন্য খুবই ন¤্র স্বভাবের লোক হইয়াছ। অন্যথায় তুমি যদি উগ্র স্বভাব ও পাষান হৃদয়ের অধিকারী হইতে তবে এত সব লোক তোমার চতুর্দিক হইতে দূরে সরিয়া যাইত।’ (কুরআন – ৩:১৫৯)
বিনয়
নবী করীম (সাঃ) এর প্রতি জনগণ অতিরিক্ত শ্রদ্ধা প্রদর্শন করলে তিনি তাদের নিষেধ করতেন। সভা-সমাবেশ যেখানেই তিনি জায়গা পেতেন সেখানেই বসে যেতেন এবং কখনও ভালো বা সুন্দর জায়গা চাইতেন না। তিনি কখনও আলাদা পোষাক পরতেন না, যাতে করে তাকে সাহাবীদের (সাথী) (রাঃ) চাইতে দেখতে স্বতন্ত্র লাগে অথবা তাদের চাইতে উচ্চমর্যাদা সম্পন্ন মনে হয়। তিনি অভাবী, দুঃস্থ ও অসহায় মানুষদের সাথে মিলেমিশে থাকতেন। তিনি বড়দের পাশে বসতেন এবং বিধবাদের সাহায্য করতেন। যে সব লোকেরা তাকে চিনতেন না তাদের কাছে অন্যদের ব্যাপারে কথা বলতেন এবং নিজের ব্যাপারে কিছু বলতেন না।
‘আল্লাহর! আসল বান্দাহ তারা যারা যমীনের বুকে ন¤্রতার সাথে চলাফেরা করে, আর অজ্ঞ লোকেরা তাদের সাথে কথা বলতে আসলে বলে দেয় যে, তোমাদের প্রতি সালাম।’ (ক্রুআন – ৩৩:২৯)
সাহাবীদের (রাঃ) সম্বোধন করে তিনি বলেন- আল্লাহ আমার প্রতি ওহী অবতীর্ন করেছেন, ‘তুমি অবশ্যই বিনয়ী হবে। কেউ কারো ওপর যুলুম-নির্যাতন করবে না’। তিনি এতটাই বিনয়ী ছিলেন যে তিনি ভীত-সন্ত্রস্ত থাকতেন লোকেরা যাতে আল্লাহর পরিবর্তে তাকে পূজা-অর্চনা শুরু করে না দেয়। ‘তোমরা আমার অতিরিক্ত প্রশংসা কোরো না যেমনটা খ্রীষ্টানরা মরিয়ম পুত্র ঈসা (আঃ) এর ক্ষেত্রে করেছিল। আমি আল্লাহর এক দাস (বান্দাহ) মাত্র, তোমরা আমাকে আল্লাহর বান্দাহ ও রসূল (বার্তাবাহক) হিসাবে ডাকো।’
আদর্শ স্বামী
নবী করীম (সাঃ) এর প্রিয় স্ত্রী আয়েশা (রাঃ) তার মহান স্বামী সম্পর্কে বলেন, ‘তিনি সবসময় বাড়ীর কাজে আমাকে সাহায্য-সহযোগিতা করতেন এবং মাঝে মাঝে নিজের কাপড় সেলাই করতেন, জুতো মেরামত করতেন এবং মেঝে ঝাঁট দিতেন, তিনি দুধ দহন করতেন, পশুদের দেখভাল করতেন ও খাওয়াতেন এবং তিনি গৃহস্থালীর কাজকর্মও করতেন’।
‘তাহাদের সহিত মিলিয়া সদ্ভাবে জীবন-যাপন কর।’ (কুরআন – ৮:১৯)
পূর্বে যা আলোচনা করা হল তা মুহাম্মদ (সাঃ) এর জীবনের কয়েকটি ঘটনা মাত্র। উল্লেখিত দয়া, কোমলতা ও ন¤্রতার উপমাগুলো অনেকের কাছে বিস্ময়কর মনে হতে পারে কেননা প্রচার মাধ্যম ধারাবাহিক ভাবে ইসলামের ব্যাপারে ভুল-ভ্রান্তি উপস্থাপন করে যাচ্ছে।
‘ইহাতে সন্দেহ নাই যে, তুমি নৈতিকতার অতি উচ্চমর্যাদায় অভিষিক্ত’ (কুরআন – ৬৮:৪)
অমুসলিম মণীষীদের মন্তব্য
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা নেতা মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী বলেছেন ‘বিশ্বে ইসলাম প্রসার লাভ করেছে একান্ত সরলতা, চরম বিন¤্রতা, বন্ধু ও সাথীদের প্রতি তাঁর গভীর মনোযোগ, সহযোগিতা, অকুতোভয়, আল্লাহর প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস ও লক্ষ্যের উপর অবিচলতার সাহায্যে – তরবারির সাহায্যে নয়, নবী (সাঃ) সবকিছু এগিয়ে নিয়ে গেছেন এবং সকল বাধা বিপত্তি অতিক্রম করেছেন’। ‘ব্রিটিশ দার্শনিক জর্জ বার্নাড’শ ঘোষনা করেন যে বিশ্বের জন্য মোহাম্মদ (সাঃ) এর মত মনের অধিকারী মানুষের খুবই দরকার। ক্রীষ্টানরা ধর্মীয় বিতৃষ্ণার কারণে নবী (সাঃ) কে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করে। কিন্তু মুহাম্মদ (সাঃ) এর জীবনী পাঠ করার পর আমার কাছে বিস্ময়কর ও অলৌকিক মনে হয়েছে। আমি উপসংহারে বলব যে, তিনি আমাদের সমস্যার সমাধান করে দিতেন এবং যে শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য বিশ্ব লালায়িত তা দান করতে পারতেন।’
‘যাহারা ঈমান আনিবে ও নেক কাজ করিবে তাহাদের প্রতি ¯্রষ্টার এই ওয়াদা যে তাহাদের ভুল-ভ্রান্তি মাফ করিয়া দেওয়া হইবে এবং তাহারা বড় প্রতিফল পাইবে’। (কুরআন – ৫:৯)